শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
নাহিদ হাসান:
বর্তামান বিশ্বের মানচিত্রে ইরান একটি ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। নবী করিম (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে সাহাবিদের পদচারণা, পারস্যের বিজয়, ইসলাম গ্রহণ, ইসলামি জ্ঞানের বিকাশ, আহলে বাইতের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সুফিবাদ ও কাব্যধারার বিকশিত ধারা, সবকিছু মিলে ইরানকে বলা যায় ইসলামি ইতিহাসের এক মহিমান্বিত অধ্যায়। বিশ্বে ইসলামের যে বিশাল জ্ঞান-ভাণ্ডার, তা গঠনে ইরানের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। হাদিস, ফিকহ, দর্শন, সাহিত্য, স্থাপত্য, ক্যালিগ্রাফি, প্রতিটি শাখায় পারস্যভূমি তার অমøান স্বাক্ষর রেখে গেছে। শুধু তাই নয়, ইসলামি সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইরানি আলেম, কবি, দার্শনিক ও শিল্পীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম গাজালি, রুমি, সাদির পদচারণা ছিল ইরানের ভূমিতে। এই লেখায় আমরা ফিরে যাব সেই ইরানের দিকে, যে ইরান তার অতীত ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম সমাজে তৈরি করেছিল এক গর্বিত অবস্থান। ইসলামি বিশ্বে ইরান কীভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, সেই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
পারস্যে ইসলাম: ইসলামের সূচনালগ্নে পারস্য (বর্তমান ইরান) ছিল একটি বিশাল সাম্রাজ্য। হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতের সময় পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চল মুসলিম বাহিনীর মাধ্যমে বিজিত হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, কারণ পারস্য তখনকার পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর সাম্রাজ্য ছিল।
পারস্য বিজয়ের পর ইসলামের বাণী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু ইরানি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণকারী এই ইরানিরা শুধু ধর্ম মেনে থেমে থাকেননি, বরং তারা জ্ঞান, সাহিত্য, ফিকহ ও হাদিস শাস্ত্রে অসামান্য অবদান রাখতে শুরু করেন।
বিখ্যাত সাহাবি: ইরানের প্রথম দীপ্তিমান তারকা সাহাবি সালমান ফারসি (রা.)। ইরান ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পরিচিতি পায় সাহাবি সালমান আল-ফারসি (রা.)-এর মাধ্যমে। তিনি ছিলেন একজন পারস্য নাগরিক, যিনি সত্য ধর্মের সন্ধানে বহু পথ ঘুরে ইসলামের সান্নিধ্যে আসেন এবং হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
হিজরতের পর মদিনায় তার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি ইসলামের মহান সেনানায়ক হয়ে ওঠেন। খন্দকের যুদ্ধে তার দেওয়া পরামর্শ ছিল ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়, তিনি শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিখা খননের কৌশল দেন, যা সফল হয় এবং মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত হয়।
হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রের চর্চা: হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রের বহু ইমাম ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। ইরানি মুসলমানদের অন্যতম বড় অবদান হাদিস ও ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রে। অনেকেই ভাবেন, আরব মুসলমানরাই কেবল হাদিস বা ইসলামি জ্ঞানের মূল প্রচারক, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসাঈ, ইমাম তিরমিজি, ইমাম গাজালি, ইমাম হিব্বানÑ এসব খ্যাতনামা মুহাদ্দিসের অধিকাংশই ছিলেন পারস্য অঞ্চলের। উদাহরণস্বরূপ ইমাম বুখারি (রহ.) ছিলেন বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্গত বুখারা নগরের অধিবাসী, যা ঐতিহাসিক পারস্য অঞ্চলের অংশ। ইমাম মুসলিম (রহ.) ছিলেন নিশাপুরের, যা বর্তমানে ইরানের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম গাজালি (রহ.) ছিলেন ইসলামি দার্শনিকতার জগতে কিংবদন্তি, যিনি ইরানের তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
নবী পরিবার: ইরানে আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের প্রতি প্রেম ও শ্রদ্ধা চর্চা অত্যন্ত সুগভীর। ইসলামের ইতিহাসে আহলে বাইতের সদস্যদের অনেকেই পারস্য অঞ্চলে সফর করেছেন, কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন কিংবা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। ইরানের বহু শহরে আহলে বাইতের বংশধরদের কবর, মাজার ও স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, যা ইরানিদের হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক।
ইসলামি স্থাপত্য ও ক্যালিগ্রাফি: ইসলামি স্থাপত্য ও ক্যালিগ্রাফির ক্ষেত্রে ইরান বিশ্ববিখ্যাত। বিশেষ করে ইসফাহান, শিরাজ, ইয়াজদ, কাশান, মাশহাদ ও তেহরানে রয়েছে এমন সব মসজিদ, মাদ্রাসা ও সমাধি, যা শুধু মুসলিমদের নয়, সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। বিশেষ উল্লেখযোগ্য মসজিদ হলো শাহ মসজিদ (ইসফাহান), ইসলামি স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন পিঙ্ক মসজিদ (শিরাজ), রঙিন কাচের আলো-ছায়ার খেলায় দর্শকদের বিমোহিত করে ইমাম রেজা কমপ্লেক্স (মাশহাদ)।
ইসলামি শিল্প-সাহিত্য: ইরান একদিকে যেমন হাদিস ও ফিকহের ভূমি, তেমনি তাসাউফ, ইসলামি দর্শন ও কবিতারও প্রাণকেন্দ্র। ফারসি ভাষায় রচিত বহু সুফি কবিতা আজও বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত। রুমি, হাফিজ, সাদি, ওমর খৈয়াম, তারা সবাই ছিলেন মুসলমান কবি ও দার্শনিক, যারা ইসলামের প্রেম, আত্মশুদ্ধি ও ইমানের গভীর বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতায় কবিতায়।
বিপ্লব ও রাজনৈতিক জাগরণ: ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ঘটে নতুন বিপ্লব, যার মাধ্যমে শাহ শাসনের অবসান ঘটে এবং তথাকথিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিপ্লব ছিল আধুনিক সময়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় রাজনৈতিক জাগরণ। এতে করে ইরান শুধু ধর্মীয় দিক দিয়ে নয়, রাজনৈতিকভাবেও বিশ্বে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে।
ইরান শুধু এক দেশের নাম নয়, বরং ইতিহাস, জ্ঞান, সাহিত্য, আলেম, সুফিবাদ, স্থাপত্য ও ইসলামি সংস্কৃতির এক বিশাল ভাণ্ডার। সাহাবিদের পদচারণা, হাদিসশাস্ত্রের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা এবং আহলে বাইতের স্মৃতিময় স্থানসমূহ সব মিলিয়ে ইরান আজও ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য পরিচিতি বহন করে।
ভয়েস/আআ